বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, চা চাষিদের কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্র চালু করা হলো। এতে চা উৎপাদনকারীদের ব্যয় কমবে। চা চাষিরা পাতার ন্যায্য মূল্য পাবেন।
শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্রের উদ্বোধন উপলক্ষে পঞ্চগড় সরকারি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব এ কথা বলেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, চা চাষিদের কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্র চালু করা হলো। এতে চা উৎপাদনকারীদের ব্যয় কমবে। চা চাষিরা পাতার ন্যায্য মূল্য পাবেন।
শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্রের উদ্বোধন উপলক্ষে পঞ্চগড় সরকারি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব এ কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের ৬৫ ভাগ চা উৎপাদন হয় সিলেট অঞ্চলে। সেখানে নিলামকেন্দ্র চালু করতে একশ বছর সময় লেগেছে। সেখানে দুই-আড়াই বছরের মধ্যে এই চা নিলামকেন্দ্রের কার্যক্রম উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হলো।’
তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্র থেকে নিলাম কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে এ অঞ্চলের চা চাষি ও চা উৎপাদনকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলো। এত দিন শুধু চট্রগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলে চা নিলাম হতো। এতে চা উৎপাদনকারীদের বেশ সমস্যা হতো এবং ব্যয় বেশি হতো। চা উৎপাদনকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্র চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে।
টিপু মুনশি বলেন, ‘দেশের তৃতীয় এই চা নিলামকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চা শিল্পে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। নিলামকেন্দ্র চালু হলে পরিবহন ব্যয়, সময় ও শ্রম ব্যয় কমবে।’
তিনি বলেন, ‘চা চাষিরা যাতে কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য পায় সে ব্যাপারে চা বোর্ড ও প্রশাসন প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করবে।’ তিনি চা চাষিদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি গুণগত মানসম্পন্ন পাতা সরবরাহ করার আহ্বান জানান।
তিনি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চা পাতা সংগ্রহ করার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এসব যন্ত্রের দাম আড়াই লাখ টাকা। আমরা এসব যন্ত্র বিনামূল্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করবো।’
তিনি বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত চা চট্টগ্রামে নিতে পরিবহন খরচসহ নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হতো উৎপাদনকারীদের। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পঞ্চগড়ে চায়ের নিলামকেন্দ্রে স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন চা বাগান-সংশ্লিষ্টরা ও চেম্বারের নেতারা। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড়ে চা নিলামকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেন। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের পর পঞ্চগড়ে চা নিলামকেন্দ্র স্থাপনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও চা-বোর্ডের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল একাধিকবার পঞ্চগড় সফর করে যথার্থতা পান। ফলে চা নিলামকেন্দ্র অবকাঠামোগত সুবিধা পর্যবেক্ষণ করে উদ্বোধনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়।’
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অকশন সেন্টার করলাম কিন্তু চা চাষিরা লাভবান হলো না। যারা মাথার ঘাম ঝড়িয়ে চা উৎপাদন করলো, তারা উপযুক্ত দামে কাঁচা পাতা বিক্রয় করতে পারলো না। তাহলে এই অকশন সেন্টার মূল্যহীন। আমি চা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ পঞ্চগড়ের ডিসিকে বলেছিলাম— যেন চা চাষিরা কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য পান। অকশন সেন্টারের পাশাপাশি নির্ধারিত মূল্যে কারখানাগুলো যেন পাতা ক্রয় করে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে। না-হলে এক সময় চা চাষ বন্ধ হয়ে যাবে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘দেশের মোট চা উৎপাদনের ৬৫ ভাগই উৎপাদিত হয় সিলেট অঞ্চলে। সেখানে চায়ের অকশন মার্কেট করতে সময় লেগেছে একশ বছর। আমরা উত্তরাঞ্চলের মানুষ সৌভাগ্যবান যে, মাত্র ২০ বছরের মাথায় আজ পঞ্চগড়ে চায়ের অকশন সেন্টার উদ্বোধন করতে পারলাম।’ চা চাষিদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য পেতে হলে সঠিকভাবে পাতা চয়ন করতে হবে। বড় আকারের ডালপালাসহ পাতা কারখানায় দিলে চায়ের মান খারাপ হয়ে যায়। অকশন মার্কেটে চায়ের দাম কম পাওয়া যায়। এ জন্য মেশিন দিয়ে পাতা কর্তন করতে হবে। এতে করে সঠিকভাবে চা পাতা চয়ন করা যাবে। তবে একেকটি মেশিনের দাম আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে চা চাষিদের বিনামূল্যে মেশিন দেবো। এসব মেশিনের দেখাদেখি অন্য চা চাষিরাও উদ্বুদ্ধ হবেন।’
টিপু মুনশি বলেন, ‘শুরুতে অনলাইলে অকশন মার্কেট উদ্বোধন করা হলো। অনলাইনে তো আর দীর্ঘদিন মার্কেট চালানো যাবে না। কিছুদিন পর ফিজিক্যালি অকশন মার্কেট করতে হবে। ফিজিক্যালি মার্কেট চালু হলে বায়ারদের থাকা-খাওয়ার জন্য তারকামানের হোটেল করতে হবে। ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর চালু করা গেলে বিডার বা বায়াররা সকালে ঢাকা থেকে এসে নিলামে অংশ নিয়ে বিকালে আবার ঢাকায় ফিরতে পারবে। আমরা চেষ্টা করবো, কীভাবে এই বিমানবন্দরটি চালু করা যায়।’
‘সমতলে চায়ের ভূবন, পঞ্চগড়ে স্বাগতম’ স্লোগানে স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যান্ড টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এই নিলাম কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন রেলপথমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. নূরুল ইসলাম সুজন, পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মজাহারুল হক প্রধান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আশরাফুল ইসলাম, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও পঞ্চগড় চেম্বারের সভাপতি আব্দুল হান্নান শেখ, পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যান্ড টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমিরুল হক খোকন। অনুষ্ঠানে যার হাত ধরে পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরু সেই সময়ের জেলা প্রশাসক মো. রবিউল ইসলাম সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।
হিমালয় ব্রোকার্স লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী এম এ শাহীন জানান, আমাদের মাধ্যমে অনলাইনে নিলাম কার্যক্রম শুরু করা হয়। শুরুতে সুপ্রিম টি লিমিটেডের তৈরি চা নিলামে তোলা হয়। নিলামে ১৫ জন বিডার অংশ নেয়। নিলামে ২ মিনিট সময় নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ নামে এক বিডার প্রতি কেজি তৈরি চা ৫৪৩ টাকা দরে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে কিনে নেয়। এতে সুপ্রিম টি লিমিটেডের এক লট (২০০ কেজি) তৈরি চা নিলামে বিক্রি হয়।
তিনি আরও জানান, জেলায় চা নিলামকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হলে তৈরি করা চায়ের পরিবহন খরচ কমে যাবে। পাশাপাশি ব্যাপকভাবে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। নিলামকেন্দ্রে চায়ের উন্মুক্ত কেনাবেচায় ক্ষুদ্র চা চাষিরা চায়ের কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্যও পাবেন। এতে গোটা উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন হবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশা। জেলায় এ পর্যন্ত ১০ হাজার ২৪০ একর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে। ৮টি নিবন্ধিত ও ২০টি অনিবন্ধিত চা বাগান, সাত হাজার ৩৩৮টি ক্ষুদ্র আয়তনের এবং এক হাজার ৩৬৮টি ক্ষুদ্র চা বাগান গড়ে উঠেছে এখানে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এই জেলায় চা চাষ শুরু হয়। সেই থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বর্তমানে উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় চা অঞ্চল। বর্তমান সময়ে শুধু চা উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদিত চা বিক্রয়ের জন্য চট্টগ্রাম ও মৌলভীবাজারের নিলামকেন্দ্রে পাঠাতে হয়। এতে করে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মালিকদের পরিবহন খরচ অনেক বেশি হয়। নিলাম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যদি বেশি বেশি চা নিলাম হয়, তাহলে এই জেলায় সরাসরি নিলাম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আশরাফুল ইসলাম জানান, চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলের পর পঞ্চগড় হবে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরু হয়, পরে উত্তরাঞ্চলের আরও কয়েকটি জেলায় চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। উৎপাদনের দিক দিয়ে দেশের দ্বিতীয় চা অঞ্চল পঞ্চগড়। গত বছর জেলায় ২৫টি কারখানায় এক কোটি ৭৭ লাখ ৭৯ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে, যার বাজার মূল্য ২৬০ কোটি টাকা। দেশে মোট উৎপাদিত চায়ের ১৯ শতাংশ চা পঞ্চগড়ে উৎপাদিত হয়েছে। অনলাইনে এ কেন্দ্রটির নিলাম পরিচালনা করা হবে। এজন্য ব্রোকার ও ওয়্যার হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, পঞ্চগড়ে চা চাষি, বাগান মালিকসহ পঞ্চগড়বাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল চা নিলামকেন্দ্রের। পঞ্চগড়বাসীর জন্য এই দিনটি আসলে অনেক আনন্দের দিন। বিশেষ করে সমতলের হাজার হাজার চা চাষি, বাগান মালিকদের মনে আনন্দের জোয়ার বইছে। কারণ, যদি অনলাইনে নিলাম কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সারা দেশের বায়াররা এই নিলামে অংশ নেন, তাহলে বদলে যাবে পঞ্চগড়ের অর্থনীতি। ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত চা চাষিরা পাবেন তাদের চায়ের ন্যায্যমূল্য, এমনটাই আশা করছেন তারা। অনলাইনে চা নিলামের জন্য ‘পঞ্চগড় অকশন ডট কম’ নামে অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এরই মধ্যে চা বোর্ড দুটি ওয়্যার হাউস ও পাঁচটি ব্রোকার হাউসকে অনুমোদন দিয়েছে।
পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে চা চাষে এগিয়ে যাচ্ছে পাশের জেলা ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটও। এরইমধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ে এক হাজার ৪৫৭ দশমিক ২৯ একর, লালমনিরহাটে ২২২ দশমিক ৩৮ একর, দিনাজপুরে ৮৯ একর এবং নীলফামারীতে ৭০ দশমিক ৫৯ একর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে। সর্বশেষ উত্তরাঞ্চল চা চাষ প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়সহ পাঁচ জেলায় মোট ১২ হাজার ৭৯ দশমিক ৬ একর জমিতে ৩০টি চা বাগান এবং ৮ হাজারের বেশি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান গড়ে উঠেছে। চা উৎপাদনের হিসাবে চট্টগ্রামকে ছাড়িয়ে এ অঞ্চল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ২০২১ সালে এ অঞ্চলে চা আবাদে জমির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৯৪ একর। উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা। ২০২২ মৌসুম এক কোটি ৭৭ লাখ ৭৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে এখানে, যা বিগত বছরের তুলনায় ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি এবং দেশের মোট উৎপাদনের ১৯ শতাংশ।