রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

| ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

Campus Bangla || ক্যাম্পাস বাংলা

৫ হাজার টাকায় মেলে প্রশ্ন, সঙ্গে জিপিএ ৫!

ক্যাম্পাস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:২৭, ৮ জুলাই ২০২৪

৫ হাজার টাকায় মেলে প্রশ্ন, সঙ্গে জিপিএ ৫!

প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর অনলাইনভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে চলে আসে তার ছবি, পর্যায়ক্রমে সমাধানও। পরীক্ষাকেন্দ্রের কক্ষে বসেই স্মার্টফোনে পাওয়া সেই সমাধান দেখে উত্তরপত্রে লেখেন পরীক্ষার্থীরা। প্রশ্ন, উত্তরপত্র ও কলমের সঙ্গে স্মার্টফোনও এসব পরীক্ষার্থীদের কাছে অপরিহার্য সরঞ্জাম। মাত্র দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে এভাবেই উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা দিচ্ছে একটি কেন্দ্রের প্রায় এক হাজার পরীক্ষার্থী!

কেন্দ্র কমিটিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে কব্জায় নিয়ে পরীক্ষার্থীদের জন্য এমন বন্দোবস্ত করেছে একটি চক্র। ‘মিশন এ প্লাস’ নামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে চলছে এমন কার্যক্রম। অনুসন্ধানে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে কীভাবে একটি কলেজের অধ্যক্ষ ও পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিবের মদদে কেন্দ্র কমিটির সরাসরি সম্পৃক্ততায় বছরের পর বছর চলছে প্রশ্নফাঁস ও নকল বাণিজ্য।

সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার দুর্গম এক জনপদ মনসুর নগর ইউনিয়ন। সেখানে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতকের জন্য একটি মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ। তার পাশেই এম মনসুর আলী জাতীয় উচ্চবিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টিই অত্র অঞ্চলের এইচএসসি পরীক্ষার একমাত্র কেন্দ্র। যা শুধুমাত্র করা হয়েছে ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের জন্য।

দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় উপজেলা সদর থেকে এই কেন্দ্রে সড়ক ও নৌপথে পৌঁছাতে সময় লাগে চার থেকে ছয় ঘণ্টা। ফলে উপজেলা প্রশাসন ও শিক্ষা অফিস থেকে কেউ কেন্দ্র পরিদর্শনে যান না বললেই চলে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রটিকে ঘিরে গত ছয় বছর ধরে যেন চলছে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে নকল বাণিজ্যের উৎসব। বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য শাখা মিলিয়ে অন্তত ৯টি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে এই কারবার চালাচ্ছে চক্রটি।

গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘মিশন এ প্লাস’ ও ‘রাসেলস ভাইপার’। গ্রুপ দুটিতে বিজ্ঞান বিভাগের প্রায়  দুইশ শিক্ষার্থী যুক্ত আছে। যারা সবাই একই কলেজ ও কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী। গত পহেলা জুলাই টাকা দিয়ে পরীক্ষার্থী পরিচয়ে ‘মিশন এ প্লাস’ গ্রুপে যুক্ত হন দেশ রূপান্তরের এই প্রতিবেদক। পরদিন ছিল বাংলা দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা।

পরীক্ষা শুরুর কিছু সময় আগেই ওই গ্রুপে প্রশ্নপত্র ও এর আংশিক উত্তর দিয়ে দেয় ‘মিশন এ প্লাস’ ও ‘রাসেলস ভাইপার’ গ্রুপের নিয়ন্ত্রক শাকিল রানা। এরপর পর্যায়ক্রমে পুরো প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়া হয়। একই চিত্র ছিল ‘রাসেলস ভাইপার’ গ্রুপের ক্ষেত্রেও। এই গ্রুপেও প্রশ্ন ও উত্তর দেয় শাকিল। গ্রুপ দুটির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে চারজন এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে। যারা সবাই শাকিলের নির্দেশ মেনে চলে।

প্রশ্নফাঁস, গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ ও সমাধান দেওয়ার বিষয়ে চক্রের প্রধান শাকিল রানার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। গ্রুপের অ্যাডমিনে থাকা তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করলে অভিযোগ শুনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ফোন বন্ধ করে রাখেন। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পরে নিজেই কল করে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘আপনি যে শাকিলের কথা বলছেন আমি সেই শাকিল নই। আমি এ সবের সঙ্গে যুক্ত না।’ তাহলে প্রশ্নফাঁসের গ্রুপগুলোতে তার ফোন নম্বর অ্যাডমিনে আছে কীভাবে জানতে চাইলে শাকিল বলেন, ‘সেটা আমি জানি না।’

একইভাবে ‘করোনা ভাইরাস’ নামে আরও একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এমন কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই গ্রুপটিতে মানবিক বিভাগের প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হয়। তবে গ্রুপের সঙ্গে যুক্তদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমন আরও ছয়টি গ্রুপের ব্যাপারে জানা গেলেও সেগুলোর নাম ও সদস্যসংখ্যা জানা যায়নি।

বিজ্ঞান বিভাগের গ্রুপ দুটির নিয়ন্ত্রণকারী শাকিল রানা ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ থেকে। তার ফেসবুক আইডি ঘেঁটে জানা গেছে, বর্তমানে পড়াশোনা করছেন রাজধানীর তেজগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগে।

এসব গ্রুপে পাওয়া প্রশ্ন এবং কেন্দ্রে বসে স্মার্টফোন দেখে পরীক্ষা দেওয়ার প্রমাণ সংগ্রহে জোর দেওয়া হয়। যারই ধারাবাহিকতায় গত ২ জুলাই বাংলা দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার দিনে কেন্দ্রটির একটি ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করা হয়। যাতে পরীক্ষার শেষ সময়ে কেন্দ্রের একটি কক্ষে দেখা যায়, কয়েকজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা শেষ করে প্রবেশপত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম গুছিয়ে উঠে যাচ্ছেন। তবে বেশিরভাগই আবার দ্রুতগতিতে লিখে যাচ্ছেন উত্তরপত্রে। যারা লিখছিলেন তাদের সবার সামনেই প্রশ্নপত্র ও একটি করে স্মার্টফোন রাখা। স্মার্টফোনে দেখে পরীক্ষার্থীদের সবাই নির্ভয়ে লিখছেন। পাশেই নির্বিকার দাঁড়িয়ে দায়িত্বরত কক্ষ পরিদর্শক।’

এসব বিষয়ে মোবাইল ফোনে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় কেন্দ্র সচিব সরিষাবাড়ীর দৌলতপুর মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আব্দুল খালেকের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমি এসব অস্বীকার করছি না। তবে এখন এগুলো নিয়ে কথা বলতে পারব না।’

প্রশ্নফাঁস ও নকল বাণিজ্যে মদদের অভিযোগ আছে এই কেন্দ্র সচিবের বিরুদ্ধে। সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বললাম তো এখন কথা বলতে পারব না।’

এ অবৈধ কর্মকাণ্ডে মদদের অভিযোগ আছে আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধেও। অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন পরীক্ষা কেন্দ্রে আছি। আমার সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। এখন কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না।’

পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন ১৯৮০ অনুযায়ী কেন্দ্রটিতে পরীক্ষা চলাকালে পুরো কার্যক্রমে চারটি অপরাধ হয়েছে। আইনটির ৪ এর ক ও খ উপধারা অনুযায়ী পাবলিক পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস বা বিতরণের জন্য অপরাধে জড়িতরা তিন থেকে চার বছরের কারাদণ্ড বা অর্থসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৯ এর ক ও খ উপধারা অনুযায়ী পরীক্ষার্থীদের লিখিত, মৌখিক ও যান্ত্রিক উপায়ে নকলে সহায়তা করার জন্য দুই থেকে তিন বছর কারাদ-সহ অর্থদণ্ডের বিধান আছে।

এছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত কোনো ব্যক্তি যদি এসব অপরাধে সহায়তা করেন সেক্ষেত্রে আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এভাবে অবাধে নকল ও প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে জানাব। যেহেতু দুর্গম এলাকা, তাই কেন্দ্রটি যেন বাতিল না করে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

কেন্দ্রটির সার্বিক চিত্র তুলে ধরে বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি সিরাজগঞ্জের এডিসিকে জানানো হয়েছে। আমরা চেয়ারম্যান স্যারের (বোর্ড চেয়ারম্যান) সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’

খবর: দেশ রুপান্তর