- লেখক
চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি একটি চলমান আন্দোলন, এটি একটি অধিকার! একটি নায্য দাবী!! বলা যায়, একটি অধিকার আদায়ের আন্দোলন। দীর্ঘ ৮/৯ বছর যাবৎ এদেশের শিক্ষিত বেকার যুবকরা এ দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করে আসছে। কখনো মানববন্ধন, কখনো লিফলেট বিতরণ, কখনো উন্মুক্ত সেমিনার, কখনো আলোচনার মাধ্যমে দাবি উপস্থাপন করেছে। সর্বশেষ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ২ মাসব্যাপী লাগাতার অনশনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রকাশ করেছে এদেশের শিক্ষিত বেকার যুবকরা।
তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মরকলিপি প্রদান করেছে। দেশের ৬৪টি জেলায় জেলা প্রশাসক বরাবর স্মরকলিপি দিয়েছে। এখনো দাবী আদায়ের আন্দোলন চলমান রয়েছে। কিন্তু বিষয়টির ব্যাপারে সরকার বা সংশ্লিষ্ট মহলের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব পরিলক্ষিত হয়। অথচ বাংলাদেশের জনসমষ্টির এক বিরাট অংশ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দেশটির উপর ভর করে বোঝার মতো দাঁড়িয়ে আছে। এ বোঝা দেশের জন্য হুমকি! অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বিরাট অন্তরায়! স্থিতিস্থাপক রাষ্ট্র গঠনে প্রতিবন্ধক। অনতিবিলম্বে রাষ্ট্র যদি এ সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে রাষ্ট্র মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হবে যা উন্নয়নশীল দেশের জন্য কাম্য নয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ লক্ষ শিক্ষিত বেকার যুবক রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেরই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ পার হয়ে গেছে। এরা এখন দেশের বোঝার মতো হয়ে আছে। এদেরকে কর্মমুখী করতে পারলে একদিকে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমবে অপরদিকে দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি তরান্বিত হবে। শিক্ষিত যুবকরা যখন চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পাবে তখন এদেশের শিল্প, বানিজ্য সামগ্রিক ক্ষেত্রে প্রভুতকল্যাণ সাধিত হবে। পাশাপাশি সরকারের দেয়া যে নির্বাচনী ইশতেহার ছিল সেটিও কার্যকর হবে।
সরকারের দেয়া নির্বাচনী ইশতেহারে প্রাধান্য পেয়েছে, “প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া, যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। তরুণ যুবসমাজ; তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি। তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ২০২১ সালের মধ্যে ‘তরুণ উদ্যোক্ততা নীতি’, একটি দক্ষ ও কর্মঠ যুবসমাজ তৈরী করতে ২০২৩ সালের মধ্যে ‘কর্মঠ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচী পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রসারিত করা। বেকারত্বের হার ২০২৩ সালে ১২শতাংশে নামিয়ে আনা। ২০২৩ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি” করার কথা নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে।
সরকারের এ ধরনের মহতী ও যুগোপযোগী উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকারের সদিচ্ছা ও উদ্যোগের কোন ঘাটতি নেই। সরকারের যাবতীয় উদ্যোগকে সার্থক করে তুলতে হলে সর্বপ্রথম বেকারত্বের সমস্যা দূর করতে হবে। বেকারদের বিরাট এক অংশ চাকরিতে প্রবেশের সীমা অতিক্রম করায় এ সমস্যা মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের এ সমস্যা সামাধানের পথ হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি অত্যন্তই যুক্তিযুক্ত। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোন দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ নেই। এমনকি কোন কোন দেশে চাকরিতে প্রবেশের কোন সীমারেখাই নেই। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে (পশ্চিমবঙ্গ) চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৬ বছর, শ্রীলংকায় ও ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরে ৫৫ বছর, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইতালি, নরওয়ে, তাইওয়ান, এঙ্গোলায় ৩৫ বছর, ফ্রান্সে ৪০, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ৫৯ বছর, সুইডেনে ৪৭ বছর। বিশে^র কোন দেশেই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছর নেই; যা একমাত্র বাংলাদেশেই বিদ্যমান। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশকেও চাকরিতে প্রবেশের বয়স উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতিতে যে প্রক্রিয়া বিদ্যমান তাতে একজন শিক্ষার্থীর অনার্স, মাস্টার্স শেষ করতে সময় লেগে যায় প্রায় ২৬/২৭ বছর। প্রতিবছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী মাস্টার্স শেষ করে বের হয় চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে তার ৫ভাগ জায়গাও শূন্য থাকে না। এবং বিষয়ভিত্তিক চাকরির তেমন প্রশস্ত ক্ষেত্র আমাদের দেশে না থাকায়, ২৬/২৭ বছরের একজন শিক্ষিত যুবককে চাকরি যুদ্ধে হুমড়ি খেয়ে কোমর বেধে লেগে যেতে হয়। চাকরি নামক যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে করতেই কোন ফাঁকে যে ৩০ পার হয়ে যায় তা টেরই পাওয়া যায় না। আর ৩০ পার হওয়া মানেই একজন তরতাজা শিক্ষিত যুবককে জীবন্ত লাশ হয়ে থাকা। অচল হয়ে যায় তার দীর্ঘদিনের ঘামঝরানো কষ্টার্জিত সার্টিফিকেট।
সমসাময়িক কয়েকটি বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির পরিক্ষা পর্যালোচনা করলে বিষয়টি বুঝতে আরো স্পষ্ট হবে। ৩৮তম বিসিএস এ ২০২৪ টি পদের বিপরীতে আবেদন করে ৩ লাখ ৮৯ হাজার। ১ টি পদের বিপরীতে লড়াই করে ১৯২ জন। বাদ পড়ে (৩৮৯০০০-২০২৪)= ৩৮৬৯৭৬ জন। ৩৯তম বিসিএস (স্পেশাল) এ নিয়োগ পেলেন মাত্র ৪৫০০জন। ৪০তম বিসিএস এ ১৯০৩ টি পদের বিপরীতে আবেদনকারীর সংখ্যা ৪ লাখ ১২ হাজার। বাদ পড়ে (৪১২০০০-১৯০৩)= ৪১০০৯৭ জন। ৪১তম বিসিএস এ ২১৬৬ টি পদের বিপরীতে আবেদনকারীর সংখ্যা ৪ লাখ ৭৫ হাজার। বাদ পড়ে (৪৭৫০০০-২১৬৬)= ৪৭২৮৩৪ জন। সরকারি ৮টি ব্যাংকে নিয়োগ পরিক্ষায় এ ১৬৬৩ টি পদের বিপরীতে আবেদনকারীর সংখ্যা ২লাখ ১৩ হাজার। বাদ পড়ে (২১৩০০০-১৬৬৩)= ২১১৩৩৭ জন। চাকরি নামক যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে বাদ পড়া মানে এর অর্থ এই নয় যে, সে অযোগ্য বা মেধাহীন। তাদেরকে আমরা কোনভাবেই অযোগ্য বা মেধাহীন বলতে পারি না; কারণ এরাই এক সময় ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে দেশের নামিদামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চান্স পেয়ে নিজেদেরকে যোগ্য ও মেধাবী হিসেবে প্রমাণ করেছে। তাই বলছি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা যদি বাড়ানো বা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় তাহলে বেকারত্বের সমস্যা হ্রাস পাবে। এরকম বাদ পড়া আবেদনকারীর সংখ্যা হিসেব করলে দেখা যায় প্রতি বছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে এ সংখ্যা এখন প্রায় ২৮ লাখের উপরে ছাড়িয়েছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির জরিপে দেখা যায়, দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের হার ১১ ভাগ; যা উচ্চ শিক্ষিত বেকার সংখ্যায় এশিয়া মহাদেশে ২য় সর্বোচ্চ। বেকারত্বে এশিয়ায় ২৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ২য় অবস্থানে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বেকারত্বের নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। দেশে শিক্ষিত বেকারের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষিত বেকাররা পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বেকারত্বের বহুমুখী সমস্যা চিন্তা করে হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো উচিত।
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। তখন চাকরিতে যোগদানের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়েছিল। তখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আায়ূ ছিল ৫৭ বছর। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আায়ু প্রায় ৭৩ বছর। ৩০ বছর আগে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যা ছিল আজও যদি তা-ই থাকে তাহলে দেশের বোঝা কিভাবে অপসারণ হবে? বিশ্বের ১৬২ টি দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বা এর ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে হলে বেকারত্বের সমস্যা সর্বপ্রথম দূর করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত করতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোও বাস্তবে রুপ নিবে। সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি যৌক্তিক বিষয়। এবিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল সুদৃষ্টি দিলে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব।
লেখক: সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখকের নিজের। ক্যাম্পাস বাংলা কোনভাবেই এই বিভাগের লেখক কিংবা লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"