সরকারি কলেজশিক্ষকেরা কর্মকর্তা হতে চান কেন? এ আলাপ কেবল সাধারণ মানুষের নয়, এ প্রশ্ন আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশের। এমনকি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজন, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছেও বিষয়টি অস্পষ্ট।
এ–জাতীয় বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের মূলে রয়েছে দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ক্যাডারগুলোর গঠন, পরিচালনা, কর্মপরিধি এবং এ–সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণার অভাব।
এখনো প্রায় সব কটি মন্ত্রণালয়ের সচিব একটিমাত্র ক্যাডারের কর্মকর্তা। দু–একটা ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ অধিদপ্তর ও দপ্তরের মহাপরিচালক বা পরিচালকও সেই একমাত্র ক্যাডারের কর্মকর্তা।
ফলে আমজনতা থেকে প্রাজ্ঞজন, সবার কাছে গুটিকয় সার্ভিসে কর্মরত ব্যক্তিরাই কর্মকর্তা বলে বিবেচিত হন।
পাঠকদের জানাতে চাই, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কলেজে যোগদান করা শিক্ষকেরা কর্মকর্তা হতে চান না। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা কর্মকর্তা হিসেবেই চাকরিতে যোগদান করেন।
ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিস আইনি স্বীকৃতি পায় ১৯৭৫ সালে। মূলত ঔপনিবেশিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করে শিক্ষা ব্যবস্থাপনাসহ দেশের সামগ্রিক প্রশাসনিক কাঠামোকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপযোগী করে গড়ে তুলতে, সরকার ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করে। সেই আইনের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস ১৪টি ক্যাডার সার্ভিসের প্রবর্তন করে। এর মধ্যে অন্যতম একটি সার্ভিস হলো বিসিএস (শিক্ষা: সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।
ক্যাডার সার্ভিসগুলোর গঠন, পদের ধরন ও পদসংখ্যা নির্দিষ্ট করে ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিটি ক্যাডারের জন্য পৃথকভাবে ক্যাডার কম্পোজিশন রুলস জারি করা হয়। বিসিএস (শিক্ষা: সাধারণ শিক্ষার) ক্যাডারের জন্য প্রণীত হয় দ্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (এডুকেশন: জেনারেল এডুকেশন) কম্পোজিশন ক্যাডার রুলস, ১৯৮০। পরবর্তী সময়ে সংশোধনীর মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসে ক্যাডারের সংখ্যা ৩০–এ উন্নীত করা হয়, তবে বর্তমানে তার সংখ্যা ২৬।
ক্যাডার কম্পোজিশন রুলস ১৯৮০ অনুযায়ী, প্রতিটি ক্যাডার সার্ভিসের জন্য বর্তমানে বিদ্যমান বেতন স্কেল অনুযায়ী নবম গ্রেড থেকে এক নম্বর গ্রেড পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদের সমন্বয়ে তৈরি হয় পৃথক পৃথক পদ সোপান। ব্যতিক্রম ঘটে কেবল শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে।
শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগদানের পরিবর্তে শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ গন্তব্য, অধ্যাপকের পদকে আটকে রাখা হয়েছে চতুর্থ গ্রেডে।
অবশ্য সুদীর্ঘ সময় আইনি লড়াইয়ের পর আদালতের রায়ে অধ্যাপকদের জন্য অল্পসংখ্যক তৃতীয় গ্রেডের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
অথচ কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘শিক্ষা বিভাগের প্রতিটি স্তরে প্রশাসনিক সার্ভিসের সঙ্গে তুলনীয় সমতুল্য পদ থাকতে হবে। এই পদগুলোকে বেতন স্কেল, পদ মর্যাদা এবং পেশাদারি সুবিধার বিবেচনায় প্রশাসনিক সার্ভিসের একই পর্যায়ের পদগুলোর সমমানের হতে হবে। শিক্ষা বিভাগের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক কর্মকর্তার দেশের চাকরির কাঠামোর সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে (বেতন ও পদমর্যাদা বিবেচনায়) পদোন্নতির সুযোগ থাকতে হবে (জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, অধ্যায়-২২, অনুচ্ছেদ-২২.৩২)।
শিক্ষা ক্যাডারের অপর একটি আশ্চর্যজনক বঞ্চনার বিষয় হচ্ছে, শিক্ষা ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক পদটি সুদীর্ঘ সময় যাবৎ পঞ্চম গ্রেডে রাখা হয়েছে। যেখানে শিক্ষা ক্যাডারের সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপকেরাই বেতন স্কেলের পঞ্চম গ্রেডে অবস্থান করেন।
ফলে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বেতন স্কেলে গ্রেডের কোনো পরিবর্তন হয় না। অথচ সিভিল সার্ভিসের স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহযোগী অধ্যাপক পদটি চতুর্থ গ্রেডের।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টির অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, ক্যাডার কম্পোজিশন রুলস, ১৯৮০–এর বিধানগুলোর ক্রমাগত লঙ্ঘন।
ওই আইনের ধারা ৪–এর দফা ১-এ বিসিএস (শিক্ষা: সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত পদগুলো সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়, ‘তফসিলে’ উল্লেখিত পদগুলো সার্ভিস ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত হবে। আইনের ‘তফসিলে’ উল্লেখিত পদগুলো হচ্ছে জনশিক্ষা দপ্তরের (বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর) বিশেষজ্ঞ, শিক্ষা কর্মকর্তা এবং উপসহকারী পরিচালক থেকে শুরু করে তদূর্ধ্ব পদ, সম্মান কোর্সবিশিষ্ট সরকারি কলেজ, সম্মান কোর্সবিহীন সরকারি কলেজ, সরকারি টিটি কলেজ, সরকারি চারু ও কারুকলা কলেজ, সরকারি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ এবং সরকারি আলিয়া মাদ্রাসাগুলোর প্রভাষক থেকে অধ্যাপক, সহকারী হেড মাওলানা, হেড মাওলানা, উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ পদমর্যাদার সব পদ, বাংলাদেশ শিক্ষা সম্প্রসারণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম শ্রেণির সব পদ, স্কুল পরিদর্শক (এডিপিআই পদের সঙ্গে পরিবর্তনযোগ্য), প্রধান শিক্ষক (সরকারি মাধ্যমিক স্কুল), তত্ত্বাবধায়ক, পিটি ইনস্টিটিউট, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা স্কুল পরিদর্শক (বর্তমানে ডিপিইও), সহকারী স্কুল পরিদর্শক, সহকারী প্রধান শিক্ষক (সরকারি মাধ্যমিক স্কুল), সহকারী তত্ত্বাবধায়ক, পিটি ইনস্টিটিউট ইত্যাদি।
কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, শিক্ষা ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তার পদায়ন সরকারি কলেজ, সরকারি টিটি কলেজ, সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
শিক্ষা ক্যাডারের প্রতি অপর একটি নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ হচ্ছে ২৮টি নবম গ্রেডের নন–ক্যাডার পদ সৃজন করে প্রথমে প্রজেক্টের আওতায় নিয়োগ দেওয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে ওই সব ব্যক্তির চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়, যা ক্যাডার কম্পোজিশন রুলস, ১৯৮০–এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এ ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডারের সিডিউলভুক্ত ৫১২টি পদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা ক্যাডারের সিডিউলভুক্ত এমন বহু পদ রয়েছে, যেসব পদে আজ পর্যন্ত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়নের কোনো নজির নেই।
এসব পদে নন–ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বা অন্য কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রেষণে পদায়ন করা হয়েছে। আরও হতাশাজনক একটি বিষয় হচ্ছে, এসব পদে এমন কর্মকর্তারা কর্মরত, যাঁরা এমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগ লাভ করেছেন, যেখানে কোথাও বিসিএস পরীক্ষার কথা উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেদের পদের নামের পাশে নিয়মিতভাবে ‘বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে থাকেন।
ফলে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেসব কর্মকর্তা সরাসরি শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করেছেন, তাঁরা পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন। এভাবেই রুদ্ধ করা হয়েছে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা থেকে।
শিক্ষা গবেষণা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থাপকে পরিণত হওয়ার সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে দুর্বল আর জৌলুশহীন করে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মেরুদণ্ড বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারকে।
এখনো অনার্স ও মাস্টার্স কলেজের অধিকাংশ বিভাগে শিক্ষকের পদসংখ্যা চার বা সাতের মধ্যে আটকে আছে। তা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অফিস ও শ্রেণিকক্ষের অভাব, বছরজুড়ে পাবলিক পরীক্ষার দায়িত্ব পালনের পরও ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা বিবেচনায় পূর্ণ গড় বেতনে অর্জিত ছুটির সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকা, যোগ্যতা অর্জনের পরও পদোন্নতির জন্য বছরের পর বছর প্রতীক্ষা, বদলি নীতিমালার অকার্যকারিতা নিম্ন সামাজিক ও প্রশাসনিক মর্যাদা ইত্যাদি বহুবিধ না-পাওয়ার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে অবসান ঘটে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পেশাগত জীবন।
এই শিক্ষকদের কর্মস্থলে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ‘অপরাধে’ ছাত্র নামধারী বখাটের হাতে লাঞ্ছনার ভয়ে থাকতে হয়। এর সঙ্গে চকচকে গাড়ি থেকে নেমে আসা জুনিয়র ব্যাচের প্রশাসনিক কর্মকর্তার ঔদ্ধত্যের ভয় তো আছেই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (হিসাববিজ্ঞান), ময়মনসিংহ সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ।
"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখকের নিজের। ক্যাম্পাস বাংলা কোনভাবেই এই বিভাগের লেখক কিংবা লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"