ছোটবেলায় একটি মুভি দেখেছিলাম ‘হেন্স ব্যাক অব নটর ডেম’। অনেক পুরনো মুভি। নটর ডেম-এর মানে তখন জানতাম না। ঢাকার নটর ডেম কলেজের নামটি দেখলেই ওই মুভিটির কথা মনে হতো। আমাদের বাল্যবেলার স্মৃতির মধ্যে যাওয়া আসার পথে নটর ডেম কলেজ পড়ত। মনে পড়ে, সদ্য স্বাধীন দেশ। চারদিকে বিপন্ন বিপর্যস্ত অবস্থা। স্বাধীন দেশে মনে তুমুল উচ্ছ্বাস নিয়ে মেতে থাকা আর দশজন কিশোরের মতো আমিও একজন। মধুমিতা সিনেমা হলে মাঝে মাঝে ইভিনিং শো দেখে ফেরার পথে নটর ডেম কলেজ পার হতাম। সোডিয়াম আলোর নিচে অন্যরকম এক অনুভূতি হতো। নটরম ডেম কলেজে ঢাকা শহরের প্রথম সোডিয়াম আলো। আমাদের কৈশোর পেরোনো তারণ্যে আলাদা একটা ব্যঞ্জনা এনেছিল। আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম ১৯৭১ সালের। মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমরা সে পরীক্ষায় অংশ নিলাম না, পরীক্ষা দিলাম তার পরের বছর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এসএসসি ব্যাচ আমরা। এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তির পালা। বাল্যবেলা থেকে দুরন্ত স্বভাব, সিনেমা দেখা, স্টেডিয়ামে খেলা দেখে বেড়ানো আর এফডিসিতে শুটিং দেখার অভ্যেস। তার ওপর পড়েছি শতভাগ বাংলা মাধ্যমে। বড় কোনো কলেজে ভর্তির চিন্তা ছিল না। তারপরও এক রকমের অনিশ্চয়তার ভিতরেই ভর্তি ফরম তুললাম নটর ডেম কলেজের। জানতাম নটর ডেম কলেজ মানেই সেন্ট জোসেফ, সেন্ট গ্রেগোরিসহ সে সময়ের সব ইংলিশ মিডিয়াম ও মিশনারি স্কুল থেকে আসা ছেলেদের অগ্রাধিকার। তাই আমাদের এদিকে তেমন আশা ছিল না। তারপরও ভর্তি পরীক্ষায় কীভাবে যেন উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম। লিখিত পরীক্ষায় পাস করে মৌখিকেও উৎরে গেলাম। কলেজ ভবনের একতলার বারান্দায় নোটিস বোর্ডটির কথা মনে পড়ে।
সে রকম নোটিস বোর্ড সে সময়ের জন্য ছিল বিস্ময়কর। ওই নোটিস বোর্ডে আর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উল্টোদিকে ফাদার্স হোস্টেলটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিয়ম ছিল ভাইভা বোর্ড পার হয়ে প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। ফাদার অ্যামব্রোস হুইলার তখন প্রিন্সিপ্যাল। পেরিয়ে গেলাম সেই ধাপটিও। মনে হচ্ছে সেই দিনের কথা। অথচ পেরিয়ে গেছে কতদিন। সেই দিনের স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। তার আগেও নটর ডেম কলেজে ঢুকেছিলাম। কিন্তু ছাত্র হিসেবে প্রথম অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে, সেই দিনটি আমার জীবনের অনন্য এক স্মৃতিময় দিন। খুব মনে আছে, মূল ভবনের উল্টোদিকে ফাদার্স হোস্টেলটির কথা। তার আগে হোস্টেলটির দিকে কখনো চোখই পড়েনি। যখন এই কলেজের ছাত্রই হয়ে গেলাম, তখন কলেজের সবকিছুই আমার কাছে অভূতপূর্ব আর বিস্ময়কর লাগত। নিজে নিজেই যথেষ্টই গর্বিত ছিলাম। পাড়ায় ফিরে সহপাঠী বন্ধু আর পাড়ার বন্ধুদের মাঝে আমার অন্যরকম কদর হলো। সবাই অবাক। সারা দিন পড়াশোনা বাদ দিয়ে সিনেমা দেখে বেড়াই, প্রতিদিন স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাই, খ্যাপে ফুটবল খেলতে যাই, সেই ছেলে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়েছি। শুনেছিলাম আমার বাবা যখন ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন তখন আশপাশের গ্রামের মানুষ তাকে দেখতে এসেছিল। আমার ক্ষেত্রেও যেন সেই অবস্থাই হলো।
যা হোক শুরু হলো নটর ডেম কলেজ জীবন। ইংরেজি কম জানতাম বলে এক রকমের ভয় আর জড়তা কাজ করত। সে কারণেই হয়তো পেছনের দিকের বেঞ্চে বসতাম। তখন সেন্ট গ্রেগোরি, সেন্ট জোসেফসহ বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম থেকে আসা লম্বা চুলঅলা ছেলেদের দাপট। স্বাধীনতার ঠিক পর পর, তখন মুক্তিযোদ্ধারাই আমাদের নায়ক। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকরণ করে তখন লম্বা চুল রাখার ফ্যাশন চলছিল। যদিও অভিভাবকরা লম্বা চুল পছন্দ করতেন না। কিন্তু সময়ের উন্মাদনা বলে কথা। তখন আবার আযম খান, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীরদের সময়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ কনসার্ট’-এর উত্তাপ তখনো বাংলাদেশের পপসংগীত অনুরাগীদের মধ্যে রীতিমতো জাগ্রত। তখন ছেলেদের মুখে মুখে একদিকে জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ আরেক দিকে আযম খানের ‘বাংলাদেশ’ আর ‘আলাল ও দুলাল’ গানটি। আমার কলেজ জীবন আর পাঁচজন পড়ুয়া প্রতিভাবান ভালো ছাত্রের মতো ছিল না। আমি বয়সের সব মজা লুটে বেড়াতাম শহরময়। যা হোক, নটর ডেম কলেজে ক্লাস শুরু হলো। ইংরেজি ক্লাসের প্রথম দিন। তরুণ এক স্মার্ট স্যার ঢুকলেন। শ্রেণিকক্ষে পিনপতন নীরবতা। স্যারের হাতে চক। বোর্ডে লিখলেন ‘ক্লিমেন্ট রোজারিও’। বললেন, আমি ক্লিমেন্ট রোজারিও। তোমাদের ইংরেজি পড়াব। আমার কাছে ইংরেজি ক্লাসটি ছিল বড় বিড়ম্বনাময়। বাংলা মাধ্যমে পড়ে ইংরেজ স্যারের ক্লাসে ফুটফাট ইংরেজি বলা কঠিন কাজ। আমি যতটা পারতাম স্যারের চোখের আড়ালে থাকতাম। আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে আসাদুজ্জামান স্যারের কথা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্লাস। স্যার প্রথম ক্লাসে এসে তার পরিচয় দিলেন। কীভাবে যেন স্যারের সঙ্গে বেশ শখ্য গড়ে উঠল। দিনে দিনে এই স্যারই আমার জীবনের প্রিয় শিক্ষকে পরিণত হলেন। দুই বছর পরেই আসাদুজ্জামান স্যার ঢাকা বিশ্বেবিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগে যুক্ত হলেন। ইন্টারমিডিয়েটের পর আমার খুব ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্বেবিদ্যালয়ের নতুন খোলা লোকপ্রশাসন বিভাগে পড়া। যা হোক, সে সুযোগ হলো না। ভূগোলে ভর্তি হলাম। কিন্তু স্যারের সঙ্গে শখ্য রয়েই যায়। স্যারের একেবারে শেষ কর্মস্থল অর্থাৎ বিশ্বেবিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান থাকার সময়ও তাঁর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। আমার প্রতিটি কাজে তাঁর আশীর্বাদ যেমন ছিল, ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। মনে আছে, নটর ডেম কলেজের ক্লাসে স্যার একবার আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার এই ছাত্র একদিন বড় কিছু হবে’। জীবনে খুব বড় কিছু হতে পেরেছি বলে মনে করি না। তবে স্যারের সেই কথাটিকে আজও আশীর্বাদ হিসেবে বিশ্বাস করি। নটর ডেম কলেজকে ঘিরে অনেক স্মৃতি। কিন্তু কলেজের শৃঙ্খলা, পাঠক্রমের সুনির্দিষ্ট নিয়মকাঠামো আমাদের খুব বেশি অমনোযোগী হতে দিত না। তারপরও আমরা কয়েক বন্ধু কলেজ জীবনের অমনোযোগ আর আনন্দ বিনোদন থেকে নিজেদের কখনো বঞ্চিত করিনি। খুব মনে পড়ে সবচেয়ে ভালো লাগত ফাদার ভেনাসের ক্লাস। কলেজে ভর্তির অনেক আগে থেকেই তাকে চিনতাম। তিনি বিটিভিতে বহুদিন রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন। কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম জানলাম, তিনিই এই ফাদার ভেনাস। আমাদের শিক্ষক। আর মনে পড়ে গরিব নেওয়াজ স্যারের কথা। তিনিও ছিলেন প্রিয় শিক্ষকদের একজন। আমাদের সময়ে যারা নটর ডেমের শিক্ষক ছিলেন তাদের কেউই আজ আর পেশায় নেই। অনেকেই চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। তবে নটর ডেমে পড়ার দিনগুলোতে শিক্ষকদের যে শিষ্টাচার যে ন্যায়নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা শিখেছিলাম তা আজও মনে জেগে ওঠে। এখনো তার অনেক কিছুই জীবনের ব্রত হিসেবে মেনে চলি।
নটর ডেম এমনই একটি কলেজ ছিল যেখানে ছাত্র রাজনীতির কোনো সুযোগ ছিল না। স্বাধীন দেশের প্রথম ব্যাচ আমরা। আমাদের সময় প্রথমবারের মতো ছাত্রদের চাপের মুখে এখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের একটি উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। নটর ডেম কলেজ বলে কথা; যে কলেজটি শিক্ষা গ্রহণের এক আদর্শ স্থান সেখানে নির্বাচন বা রাজনীতি ছিল অনেকটাই বেমানান। তাছাড়া আমি সে সময় রাজনীতি তেমন বুঝতাম না। তাই মনে হয়েছিল কলেজটির সেই ঐতিহ্য বুঝি আর রইল না। যা হোক, নির্বাচনের দিন কি যেন এক বিষয়কে ঘিরে কলেজে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুলতান, মতিঝিল কলোনির তাজ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল। শেষমেশ নির্বাচন হলো না। ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।
কলেজ গেটের সামনে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ জানালো। সেদিন কলেজের প্রথম তলায় স্থাপিত সুন্দর নোটিস বোর্ডটি বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ভেঙে দেয়। আমার ব্যাচের অর্থাৎ ৭২-৭৩ সালে ইন্টারমিডিয়েটে যারা পড়তেন তাদের হয়তো বিষয়টি সবিস্তারে মনে আছে। তবে সেই বিক্ষোভ নৈরাজ্যের পর বিকেলে ফাদার পিসোতো সবাইকে ডাকলেন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশে কিছু কথা বললেন। এখনো তার কথা আমার মনে পড়ে। তিনি তার দেশ আমেরিকাকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তাদের দেশের প্রতি অবমাননা করা হয়েছে। যা হোক, সেদিন বেশ কয়েকজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
এগুলো সবই বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন স্মৃতি। নটর ডেম কলেজে আমার সহপাঠীর মধ্যে ফারুক, সুলতানসহ অনেকেই আজ নেই। এ ছাড়া আযম, রবিন, পারভেজ (পারভেজ ইমদাদ, এডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত), সাগর (ফরিদুর রেজা সাগর, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক), পারভেজ (আবদুর রশীদ মজুমদার, আমার ব্যবসায়িক পার্টনার) এদের সবার সঙ্গে কলেজের সেই গভীর বন্ধুত্ব আজও রয়ে গেছে।
এখনো কলেজ জীবনের বন্ধুদের পেলে স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সেই সময়ের স্মৃতি। তখন মনে পড়ে যায় অনেক শিক্ষক ও বন্ধুর কথা। নটর ডেম কলেজে যারা পড়েছে তাদের অনেকেই দেশে বিদেশে অনেক বড় বড় অবস্থানে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যখন তাদের পরিচয় জানতে পাই, তখন একই কলেজে পড়ুয়া হিসেবে ভ্রাতৃত্ব অনুভব করি।
♦ লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখকের নিজের। ক্যাম্পাস বাংলা কোনভাবেই এই বিভাগের লেখক কিংবা লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"