একটি জাতির সম্মান নির্ভর করে নাগরিকের শিক্ষা ও দক্ষতার গড় মানের ওপর। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ মূলত নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রজ্ঞা অর্জন করে। দৈনন্দিন জীবনে প্রজ্ঞাকে দৃশ্যত নিত্যপ্রয়োজনীয় মনে না হলেও দক্ষতা ছাড়া জীবিকা অর্জন অসম্ভব। তাই বাস্তবিকভাবে দেখা যায়, পৃথিবীতে যে জাতি যত বেশি দক্ষ, তাদের জীবনযাত্রার মান তত উন্নত। অন্যদিকে প্রজ্ঞাবান জাতির জীবন হয় শান্তিময় ও অনাবিল আনন্দে পরিপূর্ণ।
পৃথিবীতে যেসব রাষ্ট্র প্রভাব বিস্তারকারী কিংবা বৈশ্বিক পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এদের প্রতিটিই শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার প্রশ্নে আপসহীন।
সর্ব-পশ্চিমের যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা; ইউরোপের ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালি, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড কিংবা এশিয়ার জাপান, কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর তো বটেই; এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যেও সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার কিংবা জন্মপ্রক্রিয়া বিবেচনায় গ্রহণযোগ্যতা ও নৈতিক ভিত্তির প্রশ্নে বিশ্বব্যাপী অজনপ্রিয় রাষ্ট্র ইসরায়েল; আফ্রিকার বতসোয়ানা, মিসর; দক্ষিণ আমেরিকার কোস্টারিকা, চিলি অথবা পূর্বের অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড—যেদিকেই নজর দেওয়া যায়, শিক্ষার মানের সঙ্গে সামগ্রিক জীবন মানের উন্নতির সুস্পষ্ট ও দৃঢ় একটি সম্পর্ক দৃশ্যমান হয়।
উপমহাদেশেও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা কিংবা নেপাল-ভুটানেও শিক্ষা ও শিক্ষকের সম্মান রক্ষার্থে নিজ নিজ রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল আচরণ লক্ষ করা যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে, বিশেষত স্বাধীনতার দুই দশক পর, অর্থাৎ ১৯৯০-৯১-এর পরবর্তী সময়ে শিক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত অবহেলা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
একুশ শতকের শুরুতে দু-একজন বিশেষভাবে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্বের একক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের শিক্ষাকাঠামোর অংশবিশেষ তথা পরীক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষক নিয়োগের মতো ক্ষেত্র থেকে দুর্নীতি বিলোপের যে শক্তিশালী প্রচেষ্টা আমাদের আশাবাদী করে তুলেছিল, তা বিগত দেড় যুগে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিলুপ্ত হয়েছে।
এটা সর্বজনসিদ্ধ যে একটি শিক্ষাব্যবস্থার ভরকেন্দ্রে থাকেন একজন শিক্ষক। তিনি তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। শিক্ষার্থীর জিজ্ঞাসু হৃদয়ে অগণিত বিচিত্র প্রশ্নের জন্ম দিতে শিক্ষকের ভূমিকা হয় পথপ্রদর্শকের।
একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক সততার সঙ্গে নিজের শিক্ষার্থীর জন্য নিজেকে উন্মুক্ত করতে দ্বিধাহীন হন। শিক্ষার্থীর মনে উৎপন্ন অগণিত জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে পদ্ধতিগতভাবে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেন শিক্ষক।
কিন্তু সেই শিক্ষক যদি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে উপযুক্ত সম্মান লাভ না করেন, তখন তাঁর পক্ষে সততা বজায় রাখা যেমন দুষ্কর হয়, তেমনি রাষ্ট্রও তাঁকে সততা ও দায়িত্বশীলতার প্রশ্নে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসার নৈতিক অধিকার হারায়।
মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি ভয়ানক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নতির পথে অন্যতম প্রধান বাধা হলো আমাদের শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের খেয়ালখুশিসুলভ আচরণ। পৃথিবীর যেকোনো সভ্য রাষ্ট্রে শিক্ষকের মাসিক সাম্মানিক হয় রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য সৃষ্ট বেতনকাঠামোর একেবারে ওপরের ধাপে। অন্যদিকে বাংলাদেশে শিক্ষকদের আর্থিক নিশ্চয়তার প্রশ্নটি ভয়ংকরভাবে অবহেলিতই নয়, বরং দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অনাচারের শিকার হওয়ার ঘটনাও এখানে দেখা যায়।
এ বাস্তবতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে কি জবাব আছে, পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে নিতান্ত বাধ্য হয়ে আর্থিক সম্মানী বৃদ্ধির জন্য আবেদনকালে শিক্ষকের ওপর পুলিশের অন্যায় আচরণ দেখতে হয়?
বিশ্বাস রাখা যায়, বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক নিশ্চয় এ প্রসঙ্গে একমত হবেন যে নিজের পরম প্রিয় ও আদরের সন্তানের মেধার বিকাশ, দক্ষতা বৃদ্ধি ও সামাজিকীকরণের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মহৎ লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা নিজ সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান। আমাদের সন্তানকে যত্ন করার যে মহৎ দায়িত্ব শিক্ষকদের কাঁধে আমরা ন্যস্ত করেছি, তাঁদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোচ্চ সম্মানজনক হবে, সেটিই কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছনীয়।
দীর্ঘমেয়াদি জাতিগত লক্ষ্যের ওপর নজর রেখে রাষ্ট্রের উচিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। নাগরিকের জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন, কর্মের বিনিময়মূল্য হিসেবে বার্ষিক নিট উপার্জন, গড় জীবনমান প্রভৃতি দ্বারা আধুনিক অর্থব্যবস্থায় একটি দেশের অর্থনীতিকে পরিমাপ করা হয়। বাংলাদেশে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নিয়ে গবেষণা করলে কী ফলাফল বেরিয়ে আসবে, সেটা পূর্বনির্ধারিত না করাকে যৌক্তিক বিবেচনা করেও প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে বলা যায়, তা খুব আশাব্যঞ্জক হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
বাংলাদেশে সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক ঘোষিত চাকরি পেতে লাখ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে কত শতাংশ তরুণ প্রথম পছন্দ হিসেবে সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করা, অর্থাৎ বিসিএস সাধারণ শিক্ষাকে বেছে নেন—সেই পরিসংখ্যান নিশ্চিতভাবেই উপর্যুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আছে। বিসিএস পরীক্ষায় পররাষ্ট্র, প্রশাসন, কর, শুল্ক ও আবগারি, নিরীক্ষা ও হিসাব ইত্যাদি ক্যাডারে চাকরি পেলে আবেদনকারী তরুণেরা যে রকম উচ্ছ্বসিত থাকেন; সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ পেলে কেন তাদের মধ্যে একই মাত্রায় উচ্ছ্বাস দৃশ্যমান হয় না? এই সহজ প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য কোনো জবাব দিতে পারবে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ লাভের প্রশ্নে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের যে অদৃশ্য বাধ্যবাধকতা আবিষ্কৃত হয়, সেটি কোন মানদণ্ডে যৌক্তিক? পৃথিবীর আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে এ ধরনের আত্মবিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়, নিশ্চিতভাবে সেটি একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে আত্মতৃপ্তির একটা দীর্ঘ প্রয়াস বাংলাদেশে প্রায় সর্বজন স্বীকৃত।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো, পৃথিবীর সেরা পাঁচটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের বাধ্যবাধকতা থাকার মতো অগ্রহণযোগ্য, পশ্চাৎপদ ও হাস্যকর কোনো প্রথা জারি নেই।
প্রাথমিক শিক্ষা হলো যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জনের একদম শুরুর ধাপ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক্-প্রাথমিকসহ ছয় বছর লেখাপড়া করার অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান বাস্তবতা চাক্ষুষ করে এ কথা বলতে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে হয় না যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল মেধা ও দক্ষতাবিশিষ্ট তরুণ-তরুণীরা অন্যান্য পেশায় স্থান করে নেওয়ার ব্যর্থতাৎ থেকে জীবিকা অর্জনের নিমিত্তে নিতান্ত বাধ্যগত অবস্থায় কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নিতে আগ্রহী হন।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক নৈতিক জায়গা থেকে আজ প্রশ্ন করতে হয়, একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রভাগে এমন অযোগ্য ও অদক্ষ শিক্ষক থাকলে সেই রাষ্ট্র আদৌ কি আসন্ন দিনগুলোতে প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে টিকে থাকার জ্বালানির সন্ধান পেতে পারে?
মাধ্যমিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ আমাদের শিক্ষার্থীদের গড় ভাষা ও গাণিতিক দক্ষতা নিরূপণের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে সাফল্য-ব্যর্থতার কারণ হিসেবে কী উঠে আসতে পারে, তা অনুধাবন করা খুব কি দুরূহ কিছু?
পৃথিবীতে কিছু ব্যর্থতার মূল্য হয় খুব চড়া। বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, বাক্স্বাধীনতাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে এবং সেটি কাম্যও বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যর্থতার প্রশ্নটি নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা পর্যন্ত করার প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয় না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক পদে যাঁরা আসীন, তাঁদের মধ্যে কতজনের সন্তান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণ করে?
- লেখক: শিক্ষার্থী ও গবেষক, নোভা ইউনিভার্সিটি অব লিসবন, পর্তুগাল। (লেখাটি প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত)
"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখকের নিজের। ক্যাম্পাস বাংলা কোনভাবেই এই বিভাগের লেখক কিংবা লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"